শিরোনাম :
মেহেদির রং শুকানোর আগে প্রাণ গেল তরুণের ঘরের কাজে ব্যস্ত মা, পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যু বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্যের ডাক বিশ্বে প্রতিদিন ১০০ কোটি টন খাবার নষ্ট হয় : জাতিসংঘ ভোট ডাকাত সরকারকে প্রকাশ্যে সমর্থনকারী দেশের পণ্য বর্জন ন্যায় সঙ্গত: রিজভী চার বছরে মাধ্যমিকে ১০ লাখ শিক্ষার্থী কমেছে ভারত থেকে ১৬৫০ টন পেঁয়াজ আসছে শুক্রবার আরও কমলো রিজার্ভ ঢাবির বিজ্ঞান ইউনিটে পাসের হার ৮.৮৯ শতাংশ গণতন্ত্রের আন্দোলন ন্যায়সঙ্গত, আন্দোলনে আমরা বিজয়ী হবো: ফখরুল একনেকে ১১ প্রকল্প অনুমোদন একদিন পর বাংলাদেশি যুবকের লাশ ফেরত দিল বিএসএফ ত্রিশালে বাসচাপায় অটোরিকশার ৩ যাত্রী নিহত গাজার বর্বরতাকে ইসরায়েলি ‘গণহত্যা’ বলায় জাতিসংঘের দূতকে হুমকি শহরের চেয়ে গ্রামে বিয়ে-তালাক বেশি

নিয়াজীর চোখে জল, আকুতি ছিল গোপন আত্মসমর্পণের

  • বৃহস্পতিবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২১

ঢাকা: নিয়াজীর সঙ্গে আত্মসমর্পণ নিয়ে আলোচনা করা ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা জেনারেল জ্যাকব লেখেন, আত্মসমর্পণের শর্ত পড়ে নিয়াজীর চোখ থেকে দরদর করে পানি পড়তে থাকে, সেই সঙ্গে ঘরে নেমে আসে পিনপতন নিস্তব্ধতা। উপস্থিত অন্যদের মধ্যে অস্থিরতা দেখা দেয়। রাও ফরমান আলী বাংলাদেশ-ভারত যৌথ বাহিনীর আত্মসমর্পণে রাজি ছিলেন না। তিনি কেবল ভারতীয় বাহিনীর হাতে অস্ত্র সমর্পণ করতে চান।

মুক্তিযুদ্ধ যখন চূড়ান্ত পরিণতির দিকে, সে সময় পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক সরকার পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক সরকারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে যুদ্ধ বিরতি করা যায় কি না।

৯ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর এম এ মালিক অবিলম্বে যুদ্ধ বিরতির সুপারিশসহ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে বার্তা পাঠান। ইয়াহিয়া খান বিষয়টি ঠেলে দেন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের কাছে। বলেন, এ ব্যাপারে গভর্নরকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তিনি এ ব্যাপারে পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজীকে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে আত্মসমর্পণে যিনি রাজি করিয়েছিলেন, তিনি হলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় বাহিনীর চিফ অফ স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব।

জ্যাকব লেখেন, সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে গভর্নরের এই বৈঠকের পরিকল্পনা তারা জেনে গিয়েছিলেন। আর ১৪ ডিসেম্বরের এই বৈঠক হামলা করে তারা ভেস্তে দেন। এই হামলা করলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্ব অংশের মনোবল ভেঙে পড়বে বলে তাদের ধারণা ছিল। আর হয়েছেও তা।

তখনকার পুরোনো গভর্নর হাউসে জ্যাকবের ভাষায়- ‘ছেলের হাতের মোয়ার মতো’ অনায়াস এই হামলার পর পরিস্থিতি একেবারেই বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ডের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।

 

পাকিস্তানের চেষ্টা ছিল যুদ্ধবিরতির

১৩-১৪ ডিসেম্বরের রাতে নিয়াজী পাকিস্তানের কমান্ডার ইন চিফ জেনারেল হামিদের সঙ্গে কথা বলে তাকে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার অনুরোধ করেন। ১৪ ডিসেম্বর নিয়াজীর কাছে এক বার্তা পঠিয়ে ইয়াহিয়া অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ ও সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের জীবন রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন।

নিয়াজীকে পাঠানো ইয়াহিয়ার বার্তাটি ছিল: ‘প্রবল প্রতিকূলতার মুখেও আপনারা বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করেছেন। জাতি আপনাদের নিয়ে গর্বিত এবং সারা পৃথিবী প্রশংসায় পঞ্চমুখ। বিদ্যমান সমস্যার সমাধানকল্পে মানুষের পক্ষে সম্ভব এমন সব পদক্ষেপই আমি গ্রহণ করেছি। বর্তমানে এমন একপর্যায়ে আপনারা পৌঁছেছেন যে, এরপরে প্রতিরোধের যেকোনো প্রচেষ্টাই হবে অমানুষিক এবং সেটা কার্যকরীও হবে না ; বরং তা আরও প্রাণহানি ও ধ্বংসেরই কারণ হবে। এই অবস্থায় আপনাদের উচিত হবে যুদ্ধ বন্ধ করে পশ্চিম পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর সব সদস্য এবং অন্যান্য বিশ্বস্ত সহযোগীর জীবন রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করা। পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় সমরাভিযান বন্ধ করে পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর এবং অন্যান্য জনসাধারণ যারা দুষ্কৃতিকারীদের আক্রমণের লক্ষ্য হতে পারে, তাদের সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ভারতকে অনুরোধ করার জন্য আমি ইতিমধ্যেই জাতিসংঘে তৎপরতা চালিয়েছি।’

 

নিয়াজীর চোখে জল, আকুতি ছিল গোপন আত্মসমর্পণের
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আত্মসমর্পণের দলিলে সই করছেন জেনারেল নিয়াজী

 

এই বার্তাটি ভারতীয়রা পেয়ে যান বিকেল ৩টায়। এরপর নিয়াজী ও রাও ফরমান আলি ইউনাইটেড স্টেটস কনসাল জেনারেল হার্বার্ট স্পিভ্যাকের সঙ্গে দেখা করতে যান। স্পিভ্যাককে নিয়াজী যুদ্ধবিরতির ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করেন। জবাবে স্পিভ্যাক বলেন, বিষয়টি তার এখতিয়ারের বাইরে। তার পরও তিনি একটি বার্তা পাঠাবেন।

রাও ফরমান আলি বার্তাটির খসড়া তৈরি করে স্পিভ্যাককে দেন। এতে বলা হয়:

ক্রমবর্ধমান প্রাণহানি ও সম্পদ ধ্বংসের যবনিকাপাতের লক্ষ্যে নিম্নবর্ণিত সম্মানজনক শর্তসাপেক্ষে আমরা যুদ্ধবিরতি কার্যকর করতে ইচ্ছুক:

ক . যুদ্ধ বন্ধ হবে এবং পূর্ব পাকিস্তানে যাবতীয় সামরিক অভিযান বন্ধ হবে।

খ . পূর্ব পাকিস্তানের শাসনভার জাতিসংঘের গৃহীত ব্যবস্থা অনুযায়ী শান্তিপূর্ণভাবে হস্তান্তরিত হবে।

গ . যে বিষয়গুলোয় জাতিসংঘ নিশ্চয়তা দেবে, সেগুলো হলো:

১. পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে যেতে পারেনি, সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনীর এমন সকল সদস্যের নিরাপত্তা।

২. সকল পশ্চিম পাকিস্তানি বেসামরিক নাগরিক ও সরকারি চাকরিজীবী, যারা পশ্চিম পাকিস্তানে প্রত্যাবর্তন করতে পারেনি, তাদের নিরাপত্তা।

৩. ১৯৪৭ সাল থেকে পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসরত অস্থানীয় জনগোষ্ঠীর সদস্যদের নিরাপত্তা।

৪. মার্চ ১৯৭১ থেকে যারা পাকিস্তান সরকারের চাকরি করেছেন অথবা সরকারকে সহায়তা করেছেন এবং পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করার নিশ্চয়তা।

 

ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে (পরে শেরাটন) গভর্নরের কাছে ফরমান আলি এই বার্তার একটি অনুলিপি পাঠান। বার্তাটি ভারতে না পাঠালেও ওয়াশিংটনে পাঠানো হয়। ১৪ ডিসেম্বর আনুমানিক বিকেল ৫টায় কলকাতায় কনস্যুলার অফিসের একজন কূটনীতিক স্পিভ্যাকের সঙ্গে নিয়াজীর ভাষায় যুদ্ধবিরতি অথবা আত্মসমর্পণের প্রস্তাবনা নিয়ে তার আলোচনার কথা জেনারেল জ্যাকবকে জানান। সঙ্গে সঙ্গে তিনি কলকাতায় জাতিসংঘের কনসাল জেনারেল হার্বার্ট গর্ডনকে ফোন করেন। কিন্তু তিনি কিছু বলতে পারেননি।

জ্যাকব তার বইয়ে লেখেন, ‘জেক, সত্যি বলছি, নিয়াজির অনুরোধ সম্পর্কে আমি আসলেই কিছু জানি না।’

 

নিয়াজীর চোখে জল, আকুতি ছিল গোপন আত্মসমর্পণের 

 

এরপর জ্যাকব ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল শ্যাম মানেক শকে ফোন করে তাকে দিল্লিতে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে যোগাযোগ করতে অনুরোধ করেন।

জেনারেল মানেক শ আলোচনা করে তাকে জানান, স্পিভ্যাককে করা কোনো অনুরোধ সম্পর্কে তিনি কিছু জানেন না।

জেনারেল মানেক শ বার্তাটি পান ১৫ ডিসেম্বর। তিনি নিশ্চয়তা দেন, পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করলে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। এ বিষয়ে পাকিস্তানি পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডকে ফোর্ট উইলিয়ামে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।

পাকিস্তানি কমান্ডার-ইন-চিফ এই শর্ত গ্রহণ করার জন্য নিয়াজীকে সংকেত দেন। ১৫ ডিসেম্বর বিকেল ৫টা থেকে পরদিন বেলা ৯টা পর্যন্ত যুদ্ধবিরতির জন্য উভয়পক্ষ রাজি হয়। পরে এই মেয়াদ বেলা ৩টা পর্যন্ত বাড়ানো হয়।

 

আত্মসমর্পণ তবে নাম যুদ্ধবিরতি রাখার চেষ্টা

জ্যাকব লেখেন, ‘যতটা বোঝা যায়, ইয়াহিয়া যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছিলেন, যেটা ছিল আত্মসমর্পণেরই নামান্তর।

পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা হাসান জহির তার ‘দ্য সেপারেশন অফ ইস্ট পাকিস্তান বইতে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে, পাকিস্তানিরা ‘আত্মসমর্পণ’ শব্দটি পরিহারের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে।

ঢাকায় আত্মসমর্পণ নিয়ে আলোচনার সময় নিয়াজী আশা করেছিলেন, স্পিভ্যাককে দেয়া তাঁর প্রস্তাবনা অনুযায়ী দলিল তৈরি করা হবে। কিন্তু সেটি না হওয়ায় ঢাকায় আত্মসমর্পণের দলিল দেখার পরে সেটা গ্রহণ করতে নিয়াজীর অনীহা দেখা যায়।

 

আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি

১৬ ডিসেম্বর সকাল সোয়া ৯টায় জ্যাকবকে ফোন করেন জেনারেল মানেক শ। তিনি অবিলম্বে ঢাকায় গিয়ে সন্ধ্যার মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের যাবতীয় ব্যবস্থা করতে বলেন।

সুনির্দিষ্টভাবে কোন বিষয়ে কী কাঠামোতে আলোচনা করবেন, এই প্রশ্নের জবাব জ্যাকবকে দেননি মানেক শ। কেবল ‘বেশি ঝামেলা বাধাতে’ নিষেধ করেন। বললেন যে, কী করতে হবে, এটা তিনি ভালোই বোঝেন।

এর মধ্যে নিয়াজী রেডিও বার্তায় জ্যাকবকে মধ্যাহ্নভোজের আমন্ত্রণ জানান। তবে জ্যাকব জানিয়ে দেন তিনি যেতে তেমন আগ্রহী নন।

এরপর জ্যাকব ব্রিফ করেন বাংলাদেশ-ভারত মিত্রবাহিনীর প্রধান জেনারেল জগজিত সিং অরোরাকে। তিনি প্রস্তুতি নেন ঢাকায় যাওয়ার। সঙ্গে নেন কর্নেল ইন্টেলিজেন্স খারা ও অ্যাডভান্স হেডকোয়ার্টার্সের এয়ার কমোডর পুরুষোত্তমকে।

এর আগে আত্মসমর্পণের দলিলের যে খসড়াটি অনুমোদনের জন্য দিল্লিতে পাঠানো হয়, সেটার একটা কপি সঙ্গে নিয়ে ঢাকায় আসেন জ্যাকব।

 

নিয়াজীর চোখে জল, আকুতি ছিল গোপন আত্মসমর্পণের 

 

জ্যাকব ঢাকায় আসেন যশোর হয়ে। সে সময় মুক্তাঞ্চল এই জেলায় হেলিকপটার পাল্টান তিনি। তখন সেনা সদর দপ্তর থেকে তাকে একটি বার্তা পাঠানো হয়। তাতে বলা হয়, সরকার তাকে নিয়াজীর লাঞ্চের নিমন্ত্রণ গ্রহণ করার নির্দেশ দিয়েছে।

ঢাকার এয়ারফিল্ডের প্রবেশমুখে এসে আমরা জ্যাকব একটি হেলিকপ্টারকে চলে যেতে দেখেন। টারম্যাকে তখন ১৮ জন পাকিস্তানি সৈন্য লাইন দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। বিমানবিধ্বংসী একটি কামান হেলিকপ্টারের দিকে নিশানা করা ছিল।

এর মধ্যেই হেলিকপ্টারটি অবতরণ করে। পাকিস্তানি পূর্বাঞ্চলীয় কম্যান্ডের চিফ অফ স্টাফ ব্রিগেডিয়ার বকর সিদ্দিকী তখন দেখা করেন জ্যাকবের সঙ্গে। ঢাকায় জাতিসংঘ প্রতিনিধিও সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে আলোচনায় তার অফিস ব্যবহারের প্রস্তাব দেন জাতিসংঘের প্রতিনিধি। কিন্তু জ্যাকব তা চাননি। তিনি পাকিস্তানি সেনা-কর্মকর্তাদের সঙ্গে হালকা ছলে আলোচনা করতে করতে সদর দপ্তরে যান।

 

প্রতিশোধের স্পৃহায় মুক্তিযোদ্ধারা

জ্যাকব লেখেন, পাকিস্তানি সদর দপ্তরে যাওয়ার পথে মুক্তিবাহিনী তাদের থামায়। তারা খুবই উত্তেজিত মেজাজে ছিল। তাদের সঙ্গে ছিলেন বিদেশি সংবাদ সংস্থার কয়েকজন প্রতিনিধি।

জ্যাকব তখন তাদের জানান, যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে এবং রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করবে।

এই খবর শুনে মুক্তিযোদ্ধারা খুবই উত্তেজিত হয়ে স্লোগান দিতে থাকে। বলতে থাকে, পাকিস্তানি কমান্ডের সদর দপ্তর দখল করে নিয়াজী ও তার সঙ্গীদের ‘পাওনা’ কড়ায়-গণ্ডায় বুঝিয়ে দিতে চায়।

এটা নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে জ্যাকবের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। তিনি পরিষ্কার ভাষায় বলেন, বিনা রক্তপাতে বাংলাদেশ সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর হবে এবং এই সরকারের সদস্যরা ক্ষমতা গ্রহণের জন্য শিগ্‌গির ঢাকায় এসে পৌঁছবেন।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যেন অবনতি না ঘটে বা কোনো ধরনের প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা যাতে না নেয়া হয়, সেটি মুক্তিবাহিনীকে নিশ্চিত করতে বলেন জ্যাকব। বলেন, যুদ্ধবিরতি যেহেতু কার্যকর হয়েছে এবং পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করতে রাজি হয়েছে, জেনেভা কনভেনশনের প্রতি সম্মান দেখাতেই হবে।

কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা রাজি ছিল না। তারা স্লোগান দিতে থাকে এবং হুমকি দেয় যে, তারা কারও তোয়াক্কা করে না এবং তারা তাদের ইচ্ছেমতো কাজ করবে।

তখন জ্যাকব তাদের বলেন, জেনেভা কনভেনশনের ধারা যেন যথাযথভাবে অনুসৃত হয়, সেটি তারা নিশ্চিত করবেন।

এর পর মুক্তিযোদ্ধারা তাদের যেতে দেয় এবং বেলা ১টায় জ্যাকবরা সেনা সদর দপ্তরে পৌঁছেন।

 

নিয়াজীর সঙ্গে কী কথা

নিয়াজী তার অফিসে স্বাগত জানান জ্যাকবকে। আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন বেসামরিক বিষয়ের উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি, মেজর জেনারেল জামশেদ, নৌবাহিনী প্রধান রিয়ার অ্যাডমিরাল শরিফ, বিমানবাহিনীর এয়ার কমোডর ইমাম ও ব্রিগেডিয়ার বকর সিদ্দিকী।

জ্যাকব তখন নিয়াজীকে বলেন, টঙ্গীসহ বিভিন্ন এলাকায় তখনও সংঘর্ষ চলছে। তার উচিত লড়াই বন্ধের জন্য তার বাহিনীর প্রতি অর্ডার ইস্যু করা।

নিয়াজী যখন অর্ডার ইস্যু করছেন, তখন জ্যাকব তার কাজে মন দেন। আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য পর্যাপ্ত সৈন্য ঢাকায় এনে আত্মসমর্পণের ব্যবস্থা করার ব্যবস্থা করেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঘরোয়া পরিবেশে আত্মসর্পণের প্রস্তাব করলেও জ্যাকব চিন্তা করেন উল্টোটা।

তিনি তার বইয়ে লেখেন, ‘আমি মনে করি, এতদিন যারা নির্যাতিত নিপীড়িত হয়েছে, সেই জনগণের সামনে প্রকাশ্যেই এই আত্মসমর্পণ হওয়া উচিত।’

কিন্তু এর জন্য পর্যাপ্ত সময়ের অভাব ছিল। দুই থেকে তিন ঘণ্টা সময় নিয়ে আত্মসমর্পণ সংক্রান্ত আলোচনা, সব প্রস্তুতি শেষ করতে হবে।

 

নিয়াজীর চোখে জল, আকুতি ছিল গোপন আত্মসমর্পণের
এই দলিলেই সই করেন জেনারেল নিয়াজী

 

জ্যাকব নিয়াজীকে তাদের প্যারাশুট রেজিমেন্ট ও একটি পাকিস্তানি ইউনিট দিয়ে মেজর জেনারেল গন্দর্ভ সিং নাগরাকে গার্ড অফ অনারের আয়োজন করতে বলেন। সেই সঙ্গে আত্মসমর্পণ দলিলে সই করতে একটি টেবিল ও দুটি চেয়ারের ব্যবস্থা করতে বলেন।

এর মধ্যে ভারতীয় ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অন্য কর্মকর্তারা ঢাকায় আসতে থাকেন। ভারতীয় কর্মকর্তাদের অভ্যর্থনা জানাতে জ্যাকব আবার বিমানবন্দরে যান। তিনি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিরাপত্তার জন্য বিমানবন্দরে একটি দল পাঠানোর নির্দেশও দেন।

 

শর্ত শুনে নিয়াজীর চোখ ছল ছল

এরপর জ্যাকব আবার নিয়াজীর অফিসে ফিরে গেলে কর্নেল খারা আত্মসমর্পণের শর্তগুলো পড়ে শোনান।

জ্যাকব লেখেন, ‘নিয়াজীর চোখ থেকে দরদর করে পানি পড়তে থাকে, সেই সঙ্গে ঘরে নেমে আসে পিনপতন নিস্তব্ধতা। উপস্থিত অন্যদের মধ্যে অস্থিরতা দেখা দেয়।’

পাকিস্তানিদের আশা ছিল, ১৪ ডিসেম্বরে স্পিভ্যাককে দেয়া তাদের প্রস্তাবনা অনুযায়ী এই দলিল হবে, যেটাতে জাতিসংঘের দেয়া ব্যবস্থা অনুযায়ী যুদ্ধবিরতি ও প্রত্যাবর্তন কার্যকর করা হবে।

রাও ফরমান আলী সে সময় ভারতীয় ও বাংলাদেশের সম্মিলিত বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকৃতি জানান।

জ্যাকব জানান, তারা যে আত্মসমর্পণের দলিলটি তৈরি করেন, সেটি যেন অপমানজনক না হয়, সেটি নিশ্চিতের চেষ্টা করেছেন।

তিনি লেখেন, ‘ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায় যে, অনমনীয় নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ পরবর্তীতে সুফল বয়ে আনেনি। পরাজিত প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা না করাটাও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অতীতে যা কিছুই ঘটুক না কেন, কিছুটা ছাড় তাদের অবশ্যই দেয়া উচিত।’

নিয়াজীকে জ্যাকব বলেন, সৈনিকের প্রাপ্য সম্মান তারা পাবেন এবং জেনেভা কনভেনশন কঠোরভাবে পালন করা হবে। সংখ্যালঘু জাতিসত্তাগুলোর নিরাপত্তার নিশ্চয়তাও দেন তারা।

তিনি লেখেন, ‘এ ধরনের নিশ্চয়তা ও ধারা ইতিহাসের অন্য কোনো আত্মসমর্পণের দলিলে নেই।’

এরপর নিয়াজী দলিলটি অন্যদের পড়ার জন্য এগিয়ে দেন। তারা এর কিছু পরিবর্তন দাবি করেন।

জ্যাকব তাদের বলেন, এর শর্তগুলো যথেষ্ট উদার।

 

নিয়াজীর চোখে জল, আকুতি ছিল গোপন আত্মসমর্পণের 

 

এরপর জ্যাকব ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। পরে আবার কথা হয় নিয়াজীর সঙ্গে। তখন তিনি জিজ্ঞেস করেন, দলিলটি গ্রহণযোগ্য হয়েছে কি না। কোনো মন্তব্য না করে তিনি কাগজটা ফেরত দেন। সেটাকেই নিয়াজীর সম্মতি হিসেবে ধরে নেন জ্যাকব।

এরপর আত্মসমর্পণের প্রক্রিয়া নিয়ে নিয়াজির সঙ্গে আলোচনা হয়। নিয়াজী তখনও তার অফিসেই আত্মসমর্পণ করতে প্রস্তাব দেন। কিন্তু রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের ব্যাপারে তাদের পরিকল্পনা জানিয়ে দেন জ্যাকব।

‘এটা ঠিক নয়’ বলে নিয়াজী প্রতিবাদ করেন।

তখন জ্যাকব তাকে বলেন, ভারতীয় ও পাকিস্তানি ডিটাচমেন্ট লেফটন্যান্ট জেনারেল অরোরাকে গার্ড অফ অনার দেবে। এর পর অরোরা ও নিয়াজী দলিলে সই করবেন। সবশেষে নিয়াজী তার তরবারি সমর্পণ করবেন।

নিয়াজী জানালেন, তার কোনো তরবারি নেই।

জ্যাকব বলেন, সে ক্ষেত্রে তিনি তার পিস্তল সমর্পণ করবেন।

নিয়াজী অসন্তুষ্ট হলেও নীরব ছিলেন।

এরপরে নিয়াজী জিজ্ঞেস করেন, তার অফিসার ও সৈনিকেরা তাদের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র সঙ্গে রাখতে পারবে কি না। এই অনুরোধ বিবেচনার আশ্বাস দেন জ্যাকব।

এরপর আত্মসমর্পণের পর তার লোকজনের নিরাপত্তার কী ব্যবস্থা হবে- সে প্রশ্ন রাখেন নিয়াজী। জ্যাকব তাকে আশ্বস্ত করেন যে, তাদের সৈন্যরা শহরে ঢুকতে শুরু করেছে এবং ১৮ ডিসেম্বরের মধ্যে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মতো পর্যাপ্ত শক্তি তারা সঞ্চার করতে পারবেন।

এরপর নিয়াজী বলেন, মুক্তিবাহিনীর হাতে পর্যাপ্ত অস্ত্রশস্ত্র আছে, সেহেতু পর্যাপ্ত ভারতীয় সৈন্য এসে না পৌঁছা পর্যন্ত পাকিস্তানিরা নিজেদের কাছে অস্ত্র রাখতে পারবে কি না।

জ্যাকব বলেন, এটা তারা পারবেন। এ কারণে আত্মসমর্পণের পরেও পাকিস্তানিদের নিরস্ত্র করা হয়নি এবং এ সিদ্ধান্ত সমালোচিতও হয়।

শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানি রেডিও দিয়েই জ্যাকব তাদের সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডকে জানান, আত্মসমর্পণের সমস্ত ব্যবস্থা হয়েছে। সবাই যেন ঢাকায় চলে আসে।

 

নিয়াজীর নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তা

জ্যাকব মধ্যাহ্নভোজ সারেন নিয়াজীর সঙ্গে। এরপর বিকেল ৩টায় তাকেও বিমানবন্দরে যেতে বলেন। সামনে পাইলট- জিপ নিয়ে নিয়াজীর গাড়িতে করেই সেখানে যান।

কিন্তু সেখানে সমস্যার সূত্রপাত হয়। মুক্তিবাহিনী তাদের এয়ারফিল্ডে যেতে বাধা দেয়। তাদের কেউ কেউ গাড়ির বনেটের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

তখন গাড়িতে শিখ সেনা কর্মকর্তা খারা থাকায় সুবিধা হয়। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের বলেন যে, নিয়াজী ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে বন্দি এবং তাদের বাধা দেয়া উচিত হচ্ছে না।

তখন চার দিকে হালকা অস্ত্রের গোলাগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছিল।

জ্যাকব লেখেন, ‘এয়ারফিল্ডে নিয়াজীর নিরাপত্তা নিয়ে আমি খুব উদ্বিগ্ন ছিলাম। পাইলট-জিপে পাকিস্তানি মিলিটারি পুলিশের হাতে ছিল রিভলভার। কিন্তু দৃষ্টিসীমার মধ্যে কোনো ভারতীয় সৈন্যের দেখা নেই।

খারাকে তখন জ্যাকব বলেন যে, তা উচিত হবে কিছু ভারতীয় সৈন্য, সম্ভব হলে কিছু ট্যাংক সংগ্রহ করা।

কিছুক্ষণ পর এক ট্রাক মুক্তিবাহিনী রানওয়ের অন্য পাশে এসে থামে। এদের মধ্যে কাঁধে মেজর জেনারেল র‌্যাংকের ব্যাজ লাগিয়ে কাদের সিদ্দিকী এগিয়ে যান।

জ্যাকব লেখেন, “এই লোকটিই ‘বাঘা’ সিদ্দিকী, যাঁকে আমি তাঁর সম্পর্কে – শোনা বর্ণনার সঙ্গে মিলিয়ে চিনতে পারি।”

বিপদের গন্ধ পেয়ে নিয়াজীকে আড়াল করার জন্য প্যারাট্রুপার দুজনকে নির্দেশ দিয়ে কাদের সিদ্দিকীর দিকে এগিয়ে যান জ্যাকব। তিনি আশঙ্কা করছিলেন কাদের সিদ্দিকী হয়তো নিয়াজীকে গুলি করতে গিয়েছিলে। কিন্তু আত্মসম্পর্ণের জন্য নিয়াজীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ছিল অবশ্যম্ভাবী।

জ্যাকব যখন কাদের সিদ্দিকীকে বিমানবন্দর ত্যাগ করতে বলেন, সে সময় তিনি তা মানতে চাননি। কিন্তু পরে চলে যান। এর সামান্য পরে একটি ট্যাংক নিয়ে হাজির হন খারা।

বিকেল সাড়ে চারটায় ভারতীয় ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তারা পাঁচটি এমআই ফোর ও চারটি অ্যালুয়েট হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় পৌঁছেন। সেই দলে ছিলেন মুক্তিবাহিনীর উপ প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারও।

নিয়াজী ও জ্যাকব তাদেরকে অভ্যর্থনা জানান।

এরপর সেখান থেকেই সবাই গাড়িতে করে রেসকোর্স ময়দানের (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) দিকে যাত্রা করেন। সেখানে গার্ড অফ অনার পরিদর্শনের পর জেনারেল অরোরা ও নিয়াজী টেবিলের দিকে এগিয়ে যান।

 

আত্মসমর্পণের সময় নিয়াজীর চোখে জল

অরোরার নিয়ে আসা আত্মসমর্পণের দলিল তখন টেবিলের ওপরে রাখা হয়। নিয়াজী সেটা আরেক বার পড়ে সই করেন। অরোরাও সই করেন।

এরপর নিয়াজি তার কাঁধ থেকে সেনা অধিনায়কদের সম্মানসূচক ব্যাজ খুলে ফেলেন এবং ল্যানিয়ার্ড (ছোট দড়িবিশেষ) সহ ৩৮ রিভলবার অরোরার হাতে তুলে দেন করেন।

তখন নিয়াজীর চোখে জল দেখা যাচ্ছিল বলে উল্লেখ করেন জ্যাকব।

তিনি লিখেন, ‘সন্ধ্যা হয়ে আসছিল। রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত জনতা তখন নিয়াজী ও পাকিস্তানবিরোধী স্লোগান ও গালি দিতে থাকে।’

রেসকোর্সের আশেপাশে তেমন কোনো সৈন্য না থাকায় নিয়াজীর নিরাপত্তা আবার শঙ্কিত হয়ে পড়েন জ্যাকব। তখন কয়েকজন সিনিয়র অফিসার মিলে নিয়াজীর জন্য একটি বেষ্টনী রচনা করে তাঁকে পাহারা দিয়ে একটি ভারতীয় জিপের কাছে নিয়ে যান।

সেখানে পাকিস্তানিদের নিরস্ত্র করাসহ নানা বিষয়ে ব্রিফ করার পর আগরতলায় যাওয়ার উদ্দেশে বিমানবন্দরে ফিরে যান জ্যাকব।

সে সময় পাকিস্তান নৌবাহিনীর রিয়ার অ্যাডমিরাল শরিফ অ্যাডমিরাল কৃষ্ণণকে বিদায় জানাতে আসেন। শরিফকে কৃষ্ণণ পিস্তল সমর্পণ করতে বললে তিনি হোলস্টার থেকে পিস্তল বের করে কৃষ্ণণের হাতে তুলে দেন। এর জ্যাকবদের আমাদের হেলিকপ্টার আকাশে ওড়ে।

 

সেই অস্ত্রটি নিয়াজীর ছিল না

আত্মসমর্পণের কয়েক দিন পর নিয়াজীর সমর্পণ করা রিভলবারটি পরীক্ষা করেন জ্যাকব। তখন বুঝতে পারেন, অস্ত্রটি নিয়াজীর নয়। এটা একটা সাধারণ আর্মি ইস্যু পয়েন্ট থ্রি এইট রিভলবার। ময়লা দিয়ে এর ব্যারেল বন্ধ হয়ে আছে এবং মনে হয়, বেশ কিছুদিন এটা পরিষ্কারও করা হয়নি। ল্যানিয়ার্ডটিও নোংরা, ঘর্ষণের ফলে কয়েকটি জায়গা ছিঁড়ে গেছে।

জ্যাকব তার বইয়ে লিখেন, ‘কোনো কমান্ডিং জেনারেলের ব্যক্তিগত অস্ত্র হতে পারে না। বরং মনে হয়, নিয়াজী এটা তাঁর কোনো মিলিটারি পুলিশের কাছ থেকে নিয়ে তাঁর ব্যক্তিগত অস্ত্র হিসেবে সমর্পণ করেছেন।’

তিনি লিখেন, ‘আমার মনে হলো, নিয়াজির ভাগ্যে যা ঘটেছে, সেটা তাঁর প্রাপ্য ছিল।’

সংবাটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরো খরব
© Copyright © 2017 - 2021 Times of Bangla, All Rights Reserved