নোয়াখালী: অটোরিকশা ও চাঁদা আদায়ের আনুমানিক হিসাব অনুযায়ী, জেলায় নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত ২৮ হাজার ৪৩৮টি অটোরিকশা থেকে প্রতি মাসে চাঁদা আদায় হয় ১ কোটি ৮৫ লাখ টাকার বেশি। আর দৈনিক গড়ে ১০০ টাকা হিসাবে বিভিন্ন সড়কে চাঁদা বাবদ মাসে আদায় করা হয় ৮ কোটি ৫৩ লাখ টাকার বেশি।
নোয়াখালী জেলার প্রধান সড়কগুলোতে অনেক আগে থেকেই তিন চাকার যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তবে জেলা শহরের প্রধান সড়ক, ৯টি উপজেলার উপপ্রধান সড়ক এবং শাখা সড়কগুলোতে নিবন্ধিত সিএনজিচালিত অটোরিকশার পাশাপাশি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অনিবন্ধিত আরও প্রায় ১৫ হাজার অটোরিকশা।
জেলায় প্রায় আড়াই বছর ধরে সিএনজিচালিত অটোরিকশার নিবন্ধন কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। তবে রাস্তায় নামা বন্ধ হয়নি নিত্যনতুন অটোরিকশার। বিভিন্ন স্থানে চাঁদা দিয়ে সড়কে চলছে এসব যান।
শুধু অনিবন্ধিত নয়, নিবন্ধিত অটোরিকশাগুলো চাঁদা দিয়ে অবাধে চলছে মূল সড়কে। অভিযোগ, জেলায় পরিবহন খাতের শুধু সিএনজিচালিত অটোরিকশা থেকেই মাসে চাঁদাবাজি হয় ১০ কোটি টাকার বেশি।
নিবন্ধন কার্যক্রম বন্ধ থাকায় গত আড়াই বছরে একদিকে যেমন শতকোটি টাকার বেশি রাজস্ব হারিয়েছে সরকার, আবার জেলার প্রতিটি মোড়ে মোড়ে গড়ে উঠেছে অবৈধ সিএনজিচালিত অটোরিকশা স্ট্যান্ড।
এসব স্ট্যান্ড থেকেই শ্রমিক-মালিক নেতারা সমিতির নামে নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত সিএনজিচালিত অটোরিকশা থেকে প্রতিদিন ও মাসিক হিসেবে আদায় করছেন চাঁদা। সমিতির চাঁদা হিসেবে পরিচিত ‘জিবি’ নেয়ার পাশাপাশি লাইনম্যান, পৌর টোল ও পুলিশের নামেও মাসিক চাঁদা তোলেন এসব পরিবহন নেতারা।
অটোরিকশাচালক কামরুল ইসলাম, আলা উদ্দিন, নুরুল আমিন অভিযোগ করেন, তারা যা আয় করেন তার বেশির ভাগই চলে যায় রাস্তায়।
তারা জানান, জেলা সদরের সোনাপুর জিরো পয়েন্ট থেকে প্রতিদিন ভোর থেকে কয়েক হাজার সিএনজিচালিত অটোরিকশা জেলার বিভিন্ন সড়কে চলাচল করে। প্রতিদিন সোনাপুর জিরো পয়েন্টে এসেই প্রতিটি অটোরিকশাচালককে শ্রমিক-মালিক সংগঠনকে জিবি হিসেবে দিতে হয় ৪০ টাকা।
এ ছাড়া জিরো পয়েন্টের লাইনম্যানকে ১০ টাকা, পৌর টোল ১০ টাকা, সোনাপুর থেকে মাইজদী যাওয়ার পর লাইনম্যানকে ১০ টাকা, বেগমগঞ্জ চৌরাস্তায় টোল হিসেবে ১৫ টাকা এবং লাইনম্যানকে দিতে হয় ২০ টাকা।
প্রধান সড়ক থেকে শাখা সড়কে ঢুকলেও দিতে হয় চাঁদা। এভাবে প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত একটি অটোরিকশাকে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা চাঁদা দিতে হয়।
এটা হলো দৈনিক হিসাব। মাস হিসাবেও চাঁদা দিতে হয় চালকদের।
অটোরিকশাচালকরা জানান, প্রতি মাসে পুলিশের নাম ভাঙিয়ে অটোরিকশা সংগঠনের নেতারা সোনাপুরের প্রতিটি অনিবন্ধিত সিএনজি থেকে ৩০০ টাকা ও নিবন্ধিত সিএনজি থেকে ২০০ টাকা, মাইজদীতে ২০০ টাকা ও বেগমগঞ্জ চৌরাস্তায় ২০০ টাকা চাঁদা আদায় করেন।
এই চাঁদা শুধু সোনাপুর-মাইজদী কিংবা চৌরাস্তায় নয়, জেলার প্রতিটি উপজেলা স্ট্যান্ডের শ্রমিক-মালিক নেতারা এই চাঁদা আদায় করেন অভিযোগ করে চালকরা বলেন, ব্যক্তিগত খরচ, গ্যাস বিল ও চাঁদার টাকা উপার্জনে হিমশিম খেতে হয় তাদের। তাই বাধ্য হয়েই যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করেন তারা।
অটোরিকশা থেকে মাসে কোটি টাকার চাঁদাবাজি
চাঁদা আদায়ের জায়গাগুলোর একটি হিসাব দিয়েছেন অটোরিকশাচালক ইব্রাহিম, আমির হোসেন, আবদুল হক ও কামাল হোসেন।
তারা জানান, মাইজদী আর চৌরাস্তা ছাড়াও জেলা শহরের কিরণ হোটেল মোড়, মাইজদী বাজার, নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতাল চত্বর, জজ কোর্ট সড়ক, সুপারমার্কেট সড়ক, খলিফারহাট, উদয়সাধুর হাট, বেগমগঞ্জ চৌরাস্তা, বাংলাবাজার, সোনাইমুড়ী সাব-রেজিস্ট্রি অফিস চত্বর, বজরা বাজার, দিঘিরজান, আমিশাপাড়া বাজার, চাটখিল দক্ষিণ বাজার খিলপাড়া রোড, চাটখিল উপজেলা গেট, চাটখিল বানসা-পাওড়া সড়কে চাঁদা দিতে হয় তাদের।
বদলকোট সড়ক, চাটখিল শাহাপুর-স্যামপাড়া সড়ক, কবিরহাট, চাপরাশিরহাট, নলুয়া-ভূঁইয়ারহাট, সেনবাগ বাজার, ডমুরুয়া চৌ মোড়, কানকিরহাট, চাতারপাইয়া বাজার, সেবারহাট, সুবর্ণচরের হারিছ চৌধুরী বাজার, খাসেরহাট, ভূঁইয়ারহাট, কোম্পানীগঞ্জের বসুরহাট, চাপরাশিরহাটসহ বিভিন্ন এলাকায় গড়ে ওঠা অটোরিকশা স্ট্যান্ডে প্রতিদিনই চাঁদা দেন হাজার হাজার অটোরিকশাচালক।
নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত দুই ধরনের অটোরিকশা থেকেই তোলা হয় এসব চাঁদা। নিবন্ধিত হলে শুধু কিছু ক্ষেত্রে চাঁদার পরিমাণ কমে।
চালকরা জানান, জেলায় কমপক্ষে ২৮ থেকে ৩০ হাজার সিএনজিচালিত অটোরিকশা রয়েছে। এসব অটোরিকশার চালকদের কাছ থেকে সমিতিতে ভর্তি নামে চাঁদা আদায় থেকে শুরু করে সড়কে প্রতিদিন এবং মাসিক হিসাবে চাঁদা আদায়ে কারা জড়িত বা নিয়ন্ত্রণ করছে, প্রশাসন সবই জানে। তারা নাম বলতে পারবে না। কারণ নাম বললে পরদিন থেকে আর সড়কে উঠতে পারবে না।
অটোরিকশা ও চাঁদা আদায়ের আনুমানিক হিসাব অনুযায়ী, জেলায় নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত ২৮ হাজার ৪৩৮টি অটোরিকশা থেকে প্রতি মাসে চাঁদা আদায় হয় ১ কোটি ৮৫ লাখ টাকার বেশি। আর দৈনিক গড়ে ১০০ টাকা হিসাবে বিভিন্ন সড়কে চাঁদা বাবদ মাসে আদায় করা হয় ৮ কোটি ৫৩ লাখ টাকার বেশি।
আড়াই বছর ধরে বন্ধ অটোরিকশা নিবন্ধন
দুই বছরের বেশি সময় ধরে নিবন্ধন বন্ধ থাকায় এখন অটোরিকশার সংখ্যা মাত্রা ছাড়িয়েছে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সোনাপুর, মাইজদী, চৌরাস্তাসহ জেলার গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলো থাকে অটোরিকশার দখলে। এতে এসব সড়কে যানজট নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খায় ট্রাফিক পুলিশ।
যানজট নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে গত মঙ্গলবার সকাল থেকে এসব অবৈধ যানবাহন প্রধান সড়কে চলতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে শহরে মাইকিংও করছে ট্রাফিক বিভাগ। তবে কাজের কাজ খুব একটা হচ্ছে না।
অনিবন্ধিত অটোরিকশার মালিক এমরান হোসেন, আবু নাছের ও নাহিদ জানান, আড়াই বছর সিএনজি রেজিস্ট্রেশন বন্ধ রয়েছে। তাই চেষ্টা করেও রেজিস্ট্রেশন করাতে পারিনি।
অটোরিকশার মালিক আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘চার বছর আগে একটি সিএনজি কিনছি। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে রেজিস্ট্রেশনের জন্য বিআরটিএ নোয়াখালী অফিসে যোগাযোগ করলে জানায়, সিএনজি রেজিস্ট্রেশন বন্ধ। তাই আর রেজিস্ট্রেশন করি নাই।’
সাড়ে তিন হাজার টাকা দিয়ে সোনাপুর সিএনজি মালিক সমিতিতে ভর্তির পর সড়কে চলছে তার অটোরিকশাটি।
তিনি বলেন, ‘মাঝেমধ্যে পুলিশ ধরলে টাকা দিয়ে বা তদবির করে ছাড়িয়ে আনি। রেজিস্ট্রেশন করেও লাভ কি? রাস্তায় চলতে সব সিএনজির খরচ একই। মাসের শেষে সময়মতো চাঁদা দিয়ে দিলে আর সমস্যা হয় না।’
‘পুলিশও নিচ্ছে টাকা’
সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালকদের কাছ থেকে তোলা চাঁদার একটি অংশ পুলিশ নেয় বলেও অভিযোগ রয়েছে। আবার নিবন্ধন না থাকায় প্রধান সড়কে অটোরিকশা থামিয়ে নানা অনিয়ম দেখিয়ে প্রকাশ্যে চাঁদাবাজিও করে পুলিশ।
গত ৬ অক্টোবর শহরের পুরাতন বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ট্রাফিক সার্জেন্ট আনোয়ারকে একটি অটোরিকশা আটকে চাঁদা আদায় করতে দেখা যায়। তিনি ওই চালকের কাছে ৫০০ টাকা ঘুষ দাবি করেন। পরে ৩০০ টাকা দিয়ে রক্ষা পান চালক।
এর আগে ২৮ জুলাই সোনাপুর জিরো পয়েন্টে ট্রাফিক পুলিশ সদস্য দিলিপ ফল বহন করায় একটি অটোরিকশা থামিয়ে ৫০০ টাকা ঘুষ নেন। ওই ঘটনার দুই দিন পর একই স্থানে একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা আটকে তাকে ১০০ টাকা ঘুষ নিতে দেখা যায়।
হিসাব নেই বিআরটিএ ও ট্রাফিক বিভাগের কাছেও
নিবন্ধিত সিএনজিচালিত অটোরিকশার হিসাব থাকলেও অনিবন্ধিত অটোরিকশার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান দিতে পারেনি বিআরটিএ নোয়াখালী অফিস ও জেলা ট্রাফিক বিভাগ।
অটোরিকশা থেকে মাসে কোটি টাকার চাঁদাবাজি
কর্মকর্তারা জানান, সর্বশেষ ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে সিএনজিচালিত অটোরিকশার নিবন্ধন হয়েছে। এরপর জেলা পরিবহন কমিটির সিদ্ধান্ত না থাকায় গত আড়াই বছর নিবন্ধন কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এই সময়ে নিবন্ধনের চেয়ে অটোরিকশার সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে বলে ধারণা তাদের।
নোয়াখালী ট্রাফিক বিভাগের পুলিশ পরিদর্শক (টিআই) মো. বখতিয়ার উদ্দীন বলেন, ‘বর্তমানে সড়কে ধারণ ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে সিএনজিচালিত অটোরিকশা। সঠিক সংখ্যা জানা না থাকলেও ধারণা করা হচ্ছে, জেলায় ২০ থেকে ২৫ হাজার অটোরিকশা রয়েছে। যার কারণে যানজট নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খেতে হচ্ছে।’
সড়কে চাঁদাবাজির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘চলতি বছরের ২০ মে আমি এই জেলায় যোগদানের পর সিএনজিচালিত অটোরিকশা থেকে সমিতিতে ভর্তি বাণিজ্য, মাসিক চাঁদাসহ সব ধরনের চাঁদাবাজি বন্ধ করে দিয়েছি। অনিবন্ধিত ও নিবন্ধনের মেয়াদ শেষ হওয়া সিএনজিচালিত অটোরিকশার বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চলমান রয়েছে এবং মাইকিং করে সতর্ক করা হচ্ছে।’
বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) নোয়াখালীর সহকারী পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মো. নাজমুল হাসান বলেন, ‘মেয়াদোত্তীর্ণ ও অনিবন্ধিত সিএনজিচালিত অটোরিকশার বিরুদ্ধে নিয়মিত আমরা অভিযান চালিয়ে আসছি।
‘সড়কের অবস্থানের দিক বিবেচনায় জেলা পরিবহন কমিটির সিদ্ধান্ত না হওয়ায় ২০১৯ সালের এপ্রিল থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশার নিবন্ধন কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। তবে বৈধ অটোরিকশার ক্ষেত্রে অন্য কার্যক্রম চলমান রয়েছে।’