ঢাকা: চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হবে ৪ দশমিক ৬ শতাংশ। আর ভারতে প্রবৃদ্ধি হবে ৯ দশমিক ৫ শতাংশ। তবে মাথাপিছু জিডিপিতে ভারতকে ছাড়িয়ে যাবে বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাংক গ্রুপ এবং আইএমএফের বার্ষিক বৈঠকের আগে প্রকাশিত আইএমএফের ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে এ পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
গত বছরও আইএমএফের এই ধরনের পূর্বাভাসে ভারত ও বাংলাদেশে গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ নিয়ে আইএমএফের পূর্বাভাস বাস্তবসম্মত। করোনাকালে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় অর্থনীতিকে চাঙ্গা রেখেছে। বড় প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ হলে আরও এগিয়ে যাবে।
আইএমএফের পূর্বাভাস অনুযায়ী চলতি ২০২১ সালে চলতি মূল্যে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি হবে ২ হাজার ১৩৮ দশমিক ৭৯৪ ডলার। একই সময়ে ভারতের মাথাপিছু জিডিপি হবে ২ হাজার ১১৬ দশমিক ৪৪৪ ডলার। এর ফলে এই নিয়ে পরপর দুই বছর ভারতকে পেছনে ফেলল বাংলাদেশ।
গত সপ্তাহে চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৪ দশমিক ৬ শতাংশ হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছিল বিশ্বব্যাংক। গত এপ্রিলে ২০২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৫ শতাংশ হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছিল আইএমএফ, যা সরকারের টার্গেট ৭ দশমিক ২ শতাংশের চেয়ে বেশি।
এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান দেশ বলেন, করোনাকালে রেমিট্যান্স প্রবাহ দেশে অর্থনীতির গতি সঞ্চারে ভূমিকা রেখেছে। প্রবাহ বেশ ভালো ছিল। ফলে গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা রেখেছে। এছাড়া বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ও ভালো ছিল। তিনি বলেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সরকারের ধারাবাহিকতা দেশের অর্থনীতি প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের ম্যাজিক হিসেবে কাজ করেছে। আমরা বিদ্যুতায়নসহ বেশ কিছু প্রকল্পে মাইলফলক পর্যায়ে চলে গেছি। শতভাগ মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া ও পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও কর্ণফূলী টানেলের মতো প্রকল্পগুলো দেশকে আরও এগিয়ে নেবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সামনের দিনে রপ্তানি পণ্যে বহুমুখীকরণ জরুরি। আমরা শুধু তৈরি পোশাকের ওপর ভর করে আছি। এর পাশাপশি আরও পণ্য রপ্তানি আয়ে এগিয়ে নিতে হবে। অন্যদিকে সরকারের ধারাবাহিকতা ধরে রাখাও জরুরি।
অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, এগিয়ে যাওয়ার পেছনে দুটি উপাদান নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। একটি হলো রপ্তানি, অন্যটি রেমিট্যান্স। মাঝে রপ্তানি আয়ে কিছুটা ভাটা পড়েছিল, এখন আবার রিকভারি করেছে। অন্যদিকে রেমিট্যান্সের যে ব্যাপক প্রবাহ ছিল, তা বেশিদিন থাকবে না বলে আগেই বলা হয়েছিল। হয়েছেও তাই। তবে এখনো ২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি রয়েছে, যা মোটেও কম নয়।
তিনি বলেন, সামনের দিনে দেশ এগিয়ে নিতে হলে সরকারকে অবশ্যই বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধির দিকে মনোযোগ বাড়াতে হবে। জিডিপির তুলনায় বিনিয়োগ অনুপাত এখনো কম। এছাড়া সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা ও স্বচ্ছতা বাড়াতে হবে। আর উদ্যোক্তা সৃষ্টি ও টিকিয়ে রাখতে এসএমই খাতের প্রণোদনা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। মনে রাখতে হবে বিনিয়োগ না বাড়লে শিল্পকারখানা তৈরি হবে না, কর্মসংস্থান বাড়বে না। বেকার সমস্যার সমাধান হবে না।
আইএমএফ বলছে, করোনার প্রভাব কাটিয়ে বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশই বড় প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে। এর মধ্যে ভারতের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হবে বেশি, ৯ দশমিক ৫ শতাংশ, আর বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হবে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। ভারতের প্রবৃদ্ধি বাড়লেও আগের বছর ভারতের অর্থনীতি বেশিমাত্রায় সংকুচিত হয়েছিল। এ কারণেই আবার এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ এসেছে বাংলাদেশের সামনে।
গত বছর আইএমএফ জানিয়েছিল, ২০২০ সালে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হবে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ, আর ভারতের প্রবৃদ্ধি কমে ১০ দশমিক ৩ শতাংশ ঋণাত্মকে নেমে যাবে। এর ফলে ২০২০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি হবে ১ হাজার ৮৮৮ ডলার ও ভারতের হবে ১ হাজার ৮৮৭ ডলার। সুতরাং গতবার বাংলাদেশ ছিল ঠিক ১ ডলারে এগিয়ে।
আইএমএফ অবশ্য এখন এসে বলছে, ২০২০ সালে প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ। তবে ভারতের প্রবৃদ্ধি ছিল ঋণাত্মক (-) ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। ফলে শেষ পর্যন্ত তাদের হিসাবে ২০২০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি হয় ১ হাজার ৯৬১ দশমিক ৬১৪ ডলার এবং ভারতের ১ হাজার ৯২৯ দশমিক ৬৭৭ ডলার। সুতরাং শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি বেশি হয়েছিল ৩১ দশমিক ৯৩৭ ডলার।
মূলত এবার রেকর্ড পরিমাণ প্রবৃদ্ধি অর্জন করার কথা বলা হলেও আগের বছরের উচ্চ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধির প্রভাবেই এখনো পিছিয়ে আছে ভারত। এমনকি আগামী বছরও ভারত পিছিয়ে থাকবে বলে আইএমএফ মনে করে। চলতি বছরের পূর্বাভাসে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি বেশি হবে ২২ দশমিক ৩৫ ডলার।
আইএমএফ আরও বলেছে, চলতি ২০২১ সালে বড় অর্থনীতির দেশে প্রবৃদ্ধি ব্যাপকভাবে ইতিবাচক ধারায় ফিরবে এবং তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে থাকবে উন্নয়নশীল দেশগুলো। আইএমএফ মনে করছে, বড় অর্থনীতির দেশগুলো আগামী বছর নাগাদ মহামারীপূর্ব পর্যায়ে ফিরে যাবে।
তবে উন্নয়নশীল দেশগুলো ২০২৪ সালেও সেই পর্যায়ে যেতে পারবে না। অবশ্য আইএমএফ বাংলাদেশ সম্পর্কে ইতিবাচক পূর্বাভাসই দিয়েছে। সংস্থাটি বলছে, এ বছর দক্ষিণ এশিয়ায় তৃতীয় সর্বোচ্চ ৪ দশমিক ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে বাংলাদেশে। বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে থাকবে মালদ্বীপ ও ভারত।
আইএমএফ জানুয়ারি-ডিসেম্বর হিসাব করে প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দেয়। সংস্থাটি বলছে, বিশ্ব অর্থনীতির পুনরুদ্ধার চলমান থাকলেও এর গতি কমে গেছে। এর প্রধান কারণ চলতি বছরের দ্বিতীয়ার্ধে এসে বিভিন্ন দেশে নতুন করে করোনার ডেল্টা ধরনের সংক্রমণ এবং উন্নয়নশীল ও নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে প্রত্যাশিত টিকাদান না হওয়া। সংস্থাটির হিসাবে চলতি বছরে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে গড় প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৫ দশমিক ৯ শতাংশ। গতবার যা ছিল মাইনাস () ৩ দশমিক ১ শতাংশ।
আইএমএফের প্রধান অর্থনীতিবিদ গীতা গোপীনাথ যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে আইএমএফের দপ্তরে সংবাদ সম্মেলন করে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, মহামারী দীর্ঘ হওয়ার কারণে বিশ্ব এক প্রলম্বিত অনিশ্চয়তার মুখে পড়ছে, যা আগামী বছরেও কিছুটা থাকবে। এরপর ধীরে ধীরে তা কমে আসবে।
করোনার উৎসস্থল চীনের প্রবৃদ্ধিতে বড় ধরনের উল্লম্ফন হবে বলে মনে করছে আইএমএফ। দেশটির প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। আর এশিয়ার আরেক শক্তিশালী অর্থনীতি জাপানের প্রবৃদ্ধিও বেড়ে ৪ দশমিক ৬ শতাংশ হতে পারে।
আইএমএফের তথ্য অনুযায়ী ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে জিডিপি সংকুচিত হয়েছিল ৩ দশমিক ৪ শতাংশ। এবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ হতে পারে। গতবার যুক্তরাজ্য ও জার্মানির প্রবৃদ্ধিও নেতিবাচক ছিল। এবার যুক্তরাজ্যের ৬ দশমিক ৮ শতাংশ এবং জার্মানির ৩ দশমিক ১ শতাংশ হতে পারে।