সাভার: রাজধানীসহ পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে অনলাইন, আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকা ও কথিত টিভি চ্যানেলের অভাব নেই বললেই চলে। এর পাশাপাশি ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে তথাকথিত সাংবাদিক ও মানবাধিকার সংগঠন। নাম-ঠিকানা যাই হোক, আইডি কার্ড গলায় ঝুলিয়ে নানাভাবে মানুষকে ফাঁদে ফেলে আয়-উপার্জন করাই এদের উদ্দেশ্য।
তথ্যমতে, দেশের বিভিন্ন এলাকার অপরাধী, বহু মামলার আসামি, অশিক্ষিত, কু-শিক্ষিত ও ধান্দাবাজরা এখন সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মী বনে গেছেন। এদের হাবভাব দেখে মনে হয় অনেক বড় মাপের সাংবাদিক। অথচ কখনও তাদের সংবাদ বা ছবি কোনো পত্রিকা বা মূলধারার অনলাইনে প্রকাশ পায়নি। মানবাধিকারকর্মী পরিচয়ে একটি চক্র পত্রিকার সংবাদকে পুঁজি করে তার কপি হাতে নিয়ে দারস্থ হয় ভুক্তভোগীদের কাছে। এরপর খোলস পাল্টে চলে অর্থ বাণিজ্য।
কথিত অনলাইন টিভি, আইপিটিভি, ফেসবুক টিভি এবং তার সাংবাদিকদের বিচরণও কম নয়। এরা ক্যামেরা ও মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে চষে বেড়ায় দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত। এদের খপ্পরে পড়ে সর্বশান্ত হয় অনেক সাধারণ মানুষ।
বিভিন্ন সংঘবদ্ধ চক্র সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মী পরিচয়ে ভয়ঙ্কর অপরাধ করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। এদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে নাজেহাল হয়েছেন অনেকেই। ফোনে অফিসে বা গোপন স্থানে ডেকে চাঁদা আদায় করা, ফেসবুকে স্ট্যাটাস লিখে ব্ল্যাকমেইল করে টাকা উপার্জন করা, ছিনতাই, মাদক কারবার, মাদক সেবনসহ নানা অপরাধ করার অভিযোগ রয়েছে এসব কথিত সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীদের বিরুদ্ধে।
রাজধানীর উত্তরা, মিরপুর, ঢাকা জেলার সাভার, আশুলিয়া, ধামরাই, কেরানীগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকা এখন কথিত সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের অভয়ারণ্য। জনবহুল এসব এলাকায় খুব সহজেই দাপিয়ে বেড়ানো যায় বলে এখানে বাড়ছে সাংবাদিকতার নামে অপরাধ। অনেক দালাল, মাদক কারবারি ও ছিনতাইকারীরা পরিচয় দিচ্ছে সংবাদকর্মী হিসেবে।
ভুয়া সাংবাদিকেরা বিভিন্ন প্রতারণার ফাঁদ পেতে এবং তথাকথিত মানবাধিকার সংগঠনের সদস্য-সমর্থকরা নিজেদের ‘মানবাধিকার সাংবাদিক’ পরিচয় দিয়ে নিরীহ লোকজনকে নানাভাবে হয়রানি করছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
এসব চক্রে বিতর্কিত নারী সদস্যও থাকেন। এরা খ্যাত-অখ্যাত একাধিক গণমাধ্যমের ৪/৫টি আইডি কার্ড বুকে-পিঠে ঝুলিয়ে মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকার ও মাইক্রোবাসে ‘প্রেস’ কিংবা ‘সংবাদপত্র’ লিখে দাপিয়ে বেড়ায় সর্বত্র। তারা মূলত পুলিশ, র্যাব, ডিবি’র সোর্সের দায়িত্ব পালনেই বেশি ব্যস্ত।
‘মুছকান টিভি’ নামে এক ইউটিউব চ্যানেলের আওতাতেও রাজধানীর উপকণ্ঠ এলাকাগুলোতে দুই শতাধিক সাংবাদিককে কার্ড বিতরণ করার খবর পাওয়া গেছে। সেখানে মাদক কারবারি, সেলুন কর্মী, চা-বিক্রেতা, পরিবহন হেলপার, মাছ-সবজি বিক্রেতাসহ যে কোনো পেশার মানুষ, নাম লেখার যোগ্যতা থাকুক না থাকুক ন্যূনতম এক হাজার টাকা জমা দিয়েই ‘ক্রাইম রিপোর্টার’ পদবীযুক্ত আইডি কার্ড পেয়ে যাচ্ছেন।
রাজধানীর বৃহত্তর উত্তরাজুড়ে আরো ভয়াবহ অবস্থা। সেখানে অবস্থানরত একজন সিনিয়র সাংবাদিক জানিয়েছেন, অন্তত পাঁচশ ভুয়া সাংবাদিক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে উত্তরা এলাকা। সাংবাদিক ও মিডিয়ার নাম ব্যবহার করে এক ডজনেরও বেশি ক্লাব-সংগঠন গড়ে উঠেছে।
মূলধারার সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কেউ সংযুক্ত না থাকলেও নিজেরাই একাধিক অনলাইন নিউজ পোর্টাল খুলে সাংবাদিক-সম্পাদক বনে যাচ্ছেন। তাদের ভুয়া অনলাইন পোর্টালে যা ইচ্ছে তাই লিখে দিচ্ছেন, যাকে খুশি তার পক্ষে লিখছেন, চাঁদা না পেলেই ডুবিয়ে দিচ্ছেন। এসব অনলাইন পোর্টালগুলো আবার পত্রিকা আকারে প্রিন্ট করেও লিফলেটের মতো ছড়িয়ে দেন তারা।
ঢাকার সাভার, আশুলিয়া ও ধামরাইয়ের স্থানীয় সাংবাদিক, পুলিশ কর্মকর্তা ও সচেতন মহলের সাথে এসকল নানা বিষয়ে কথা বলে জানা গেছে, এসব এলাকায় প্রায় এক হাজারেরও বেশি কথিত সাংবাদিক রয়েছে। মানবাধিকারকর্মী রয়েছে প্রায় দুই হাজারের মতো। যেন ঘরে ঘরে সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মী। এসব এলাকার বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে তথাকথিত সাংবাদিক ও মানবাধিকার সংগঠনের অফিস।
সাভার প্রেসক্লাবের সিনিয়র সদস্য তোফায়েল হোসেন তোফা সানি বলেন, দেশে অজ্ঞাতনামা পত্রিকা ও নিবন্ধনহীন অনলাইন নিউজ পোর্টালের বিষয়ে সরকার আরও কঠোর হলে এ থেকে নিস্তার পেতে পারে সাংবাদিকতা। এসব ভুঁইফোড় অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকার কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে পেশাদার সাংবাদিকরা। পেশাদার সাংবাদিকদের ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনতে দমন করতে হবে এসব অপসাংবাদিকতা।