শিরোনাম :
বিএনপি এখন সন্ত্রাসী দলে পরিণত হয়েছে: হানিফ সূচকের সাথে বেড়েছে লেনেদেন অবরোধ সফলে কমলাপুরে যুবদলের বিক্ষোভ মিছিল বিএনপিকে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হচ্ছে না কেন, প্রশ্ন কাদেরের সিরাজগঞ্জে যুবদলের ৩ নেতা গ্রেফতার তিন টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর পদত্যাগ কার্যকর রুশ-ভারতের সাহায্য নিয়েও সরকারের পতন ঠেকানো যাবেনা বিএনপির আরও দুই নেতাকে বহিষ্কার ঋণ আমানতের সুদের ব্যবধান তুলে নিল বাংলাদেশ ব্যাংক আদালত চত্বরে ককটেল বিস্ফোরণ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ: ইইউর কারিগরি প্রতিনিধি দল ঢাকায় ক্রাচে ভর করে মিছিলে যুবদল নেতা রাজধানীতে পুলিশের অভিযানে গ্রেপ্তার ৩৪ বায়ুদূষণে আজ শীর্ষ চারে ঢাকা শ্যামলের নেতৃত্বে রামপুরায় সড়ক অবরোধ ও মিছিল

প্যাডেল স্টিমার এখন ঐতিহ্য

  • বৃহস্পতিবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

ঢাকা: নদীমাতৃক বাংলাদেশের যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে দেড়শ বছর ধরে চলা একটি জনপ্রিয় নৌযান প্যাডেল স্টিমার; যা গত বছরের সেপ্টেম্বরে বন্ধ হয়ে গেছে। এসব যান এখন পড়ে আছে বুড়িগঙ্গার বাদামতলী ঘাট, নারায়ণগঞ্জ ডকইয়ার্ড ও কাঞ্চন ব্রিজ এলাকায়। ঐতিহ্যবাহী প্যাডেল স্টিমারে ভ্রমণ করেছিলেন ব্রিটেনের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ বিশ্ববরেণ্য অনেক ব্যক্তি।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিসি) জানিয়েছে, যাত্রীর অভাবে প্যাডেল স্টিমার চলাচল বন্ধ রয়েছে। এটি আর কোনো দিনও ভেঁপু বাজিয়ে নদীর বুক চিরে চলতে দেখা যাবে না।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রথমে ঢাকা-চাঁদপুর-বরিশাল-খুলনা হয়ে কলকাতায়; পরে ঢাকা-খুলনা এবং সর্বশেষ ঢাকা থেকে বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ পর্যন্ত চলাচল করত প্যাডেল স্টিমার। এগুলোর সমসাময়িক স্টিমার পৃথিবীর কোথাও দেখা যায় না। প্যাডেল হুইলের এ স্টিমারগুলো ঐতিহ্য হিসেবে সংরক্ষণ করা হবে, যাতে মানুষ নদীপথের অতীত জানতে পারে। প্রাথমিকভাবে দেশের চারটি জায়গায় এগুলো জনগণের প্রদর্শনীর জন্য রাখার চিন্তা করা হচ্ছে।

বিআইডব্লিউটিসির কর্মকর্তারা জানান, তাদের কাছে পৃথিবীতে একসময়ের জনপ্রিয় ও ঐতিহ্যবাহী এ স্টিমার বেশি নেই। একসময় গাড়ো, কিয়ি, ফ্লোরিকান, ফ্ল্যামিঙ্গো, মোহামেন্ড, বার্মা, মাজবি, শেরপা, পাঠান, ইরানি, সিল, লালি, সান্দ্রা এবং মেকলা নামের প্যাডেল স্টিমার ছিল। পিএস অস্ট্রিচ, পিএস মাহসুদ, পিএস লেপচ ও পিএস টার্ন নামের বর্তমানে যে চারটি স্টিমার রয়েছে তার তিনটিই ব্রিটিশ আমলের। পিএস অস্ট্রিচ ১৯২৯ সালে, পিএস মাহসুদ ১৯২৮ সালে, পিএস লেপচা ১৯৩৮ সালে এবং পিএস টার্ন ১৯৫০ সালে নির্মাণ করা হয়।

অস্ট্রিচ নির্মাণ করে স্কটল্যান্ডের একটি কোম্পানি। বাকি তিনটি নির্মাণ করে কলকাতার গার্ডেন রিচ ডকইয়ার্ড। মানুষের নিত্যকার যাতায়াতের পাশাপাশি এসব নৌযানে পৃথিবীর বিখ্যাত ব্যক্তিরা আরোহণ করেছেন। ১৯৬১ সালে ব্রিটিশ রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ এই নৌযানে চড়েন। এ ছাড়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহাত্মা গান্ধী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান সহ দেশ-বিদেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের স্মৃতি রয়েছে এ বাহনে চড়ার। স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে যুগোস্লাভিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান মার্শাল টিটো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে এই স্টিমারে নৌবিহার উপভোগ করেন।

প্যাডেল স্টিমারের ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করেছেন বিআইডব্লিউটিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম মিশা। তিনি জানান, স্টিমারগুলো বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কোম্পানি ও সংস্থার মাধ্যমে পরিচালিত হতো। তাই এর সঙ্গে রয়েছে বিভিন্ন পুরোনো কোম্পানিরও স্মৃতি। যেমন ১৮৭৮ সালে রিভার স্টিম নেভিগেশন কোম্পানি লিমিটেড নামের একটি ব্রিটিশ কোম্পানি এ স্টিমারগুলো চালু করে। ১৮৯৬ সালে এগুলো ইন্ডিয়ান জেনারেল নেভিগেশন (আইজিএন) এবং রিভার স্টিম নেভিগেশনের (আরএসএন) যৌথ কোম্পানির অধীনে চলে যায়। এ যৌথ কোম্পানি ১৮৯৬ সালে বরিশালে একটি স্টিমার কারখানা নির্মাণ করে এবং একই বছর আইজিএন কোম্পানি স্টিমার পরিচালনার সুবিধার্থে বরিশাল শহরের রাজাবাহাদুর সড়ক ও বান্দরোডে পূর্ববাংলার সদর দপ্তর স্থাপন করে, যার নাম দেওয়া হয় ‘হীম নীড়’।

পাকিস্তান সৃষ্টির পর স্টিমার চলে যায় প্রথমে পাকিস্তান রিভার স্টিমার্সের (পিআরএস) হাতে। ১৯৫৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (ইপিআইডব্লিউটিএ) গঠনের পর তাদের হাতে আসে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে এর মালিকানা পায় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশন।

সম্প্রতি বুড়িগঙ্গা নদীর বাদামতলী ঘাটে দেখা যায়, সেখানে পড়ে আছে পিএস মাহসুদ ও পিএস লেপচা। দুপুর বেলা স্টিমারের নিচতলায় খাওয়াদাওয়া করছিলেন মাস্টার, সুকানি, লস্কর ও গ্রিজাররা। আলাপকালে তারা জানান, এ স্টিমার একসময় বাষ্পীয় ইঞ্জিনে চলত। নারায়ণগঞ্জের নিতাইগঞ্জে এক কয়লার ডিপোও ছিল। কিন্তু ১৯৬০ সালের পর থেকে বিভিন্ন সময় এটিকে ডিজেল ইঞ্জিনে রূপান্তর করা হয়। যেমনÑ লেপচা নামের স্টিমারটিকে ১৯৮৬ সালে ডিজেল ইঞ্জিনে রূপান্তর করা হয় আর পিএস মাহসুদকে ১৯৯০ সালের পরে ডিজেল ইঞ্জিনে রূপান্তর করা হয়।

পিএস মাহসুদের প্রথম শ্রেণির কেবিনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারী আব্দুস সালাম জানান, স্টিমারগুলোর প্যাডেলসহ অনেক অংশ আগে কাঠের ছিল। পরে এগুলো স্টিলের করা হয়। ওই সময়ের স্টিমারগুলোর মধ্যে এটি দ্রুতগতিতে চলায় এর নাম দেওয়া হয় ‘রকেট স্টিমার’। প্রতিটি স্টিমারে প্রথম শ্রেণির ১২ এবং দ্বিতীয় শ্রেণির ১০টি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কেবিন রয়েছে। এটি ১০০ টনের বেশি মালামাল বহন করতে পারে এবং যাত্রী ধারণক্ষমতা সাড়ে ৭০০-৮০০ জন।

তারা জানান, সর্বশেষ ২০২২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ঢাকা-মোরেলগঞ্জ রুটের রকেট সার্ভিস নামের এ সেবা বন্ধের ঘোষণা করা হয়। এটি একসময় কলকাতা পর্যন্ত যাওয়া-আসা করত, কিন্তু নাব্য সংকটে খুলনা পর্যন্ত যাত্রা শেষ হয়। এগুলো ২০-২২ ঘণ্টায় ঢাকা থেকে ১৩টি নদী ও ২৭টি জেলা পাড়ি দিয়ে খুলনায় পৌঁছাত।

বিআইডব্লিউটিসির জাহাজ চলাচল বিভাগের উপমহাব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) মো. নাসির চৌধুরী জানান, বর্তমানে চারটি প্যাডেল স্টিমার রয়েছে। এগুলো যাত্রী ও পণ্য পরিবহন করার মতো অবস্থায় নেই। এগুলো বিভিন্ন জায়গায় নোঙর করে রাখা হয়েছে। এর মধ্যে দুটি সদরঘাটে, একটি নারায়ণগঞ্জ ডকওয়ার্ডে ও একটি কাঞ্চন ব্রিজের কাছে রয়েছে। প্রতিটি স্টিমারে একসময় ৩০ জনের মতো জনবল ছিল। বর্তমানে ১৪-১৫ জন রয়েছেন। স্টিমার না চলায় তারা তা পাহারা দেওয়া ও রক্ষণাবেক্ষণ করছেন।

সংস্থাটির পরিচালক (বাণিজ্য) এসএম আশিকুল ইসলাম বলেন, ‘প্যাডেল স্টিমারগুলো আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অংশ। এগুলো পুনর্বাসন করে বিভিন্ন জায়গায় জনগণের প্রদর্শনীর জন্য রাখব। আমরা চারটি স্টিমারকে নারায়ণগঞ্জের কাঞ্চন ব্রিজের কাছে, একটি সদরঘাটে, একটি চাঁদপুরে ও একটি বরিশালে রাখার চিন্তা করছি। এমনও হতে পারে এগুলোর ভেতরে রেস্টুরেন্ট থাকবে। মানুষ এর ভেতরে খাওয়া-দাওয়া করবে।

সংবাটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরো খরব
© Copyright © 2017 - 2021 Times of Bangla, All Rights Reserved