ঢাকা: দেশের নাগরিক হয়েও যুগ যুগ ধরে অবহেলা ও বৈষম্যের শিকার তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠী। সেই বৈষম্যের অবসান ঘটাতে ২০১৩ সালে ‘হিজড়া’ নামে পরিচিত এই জনগোষ্ঠীকে তৃতীয় লিঙ্গের হিসেবে স্বীকৃতি দেয় সরকার। কিন্তু স্বীকৃতি মিললেও পিছিয়ে পড়া এই জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে নেওয়া সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের বেশিরভাগই এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। এ নিয়ে হতাশা জানিয়েছেন, তৃতীয় লিঙ্গের প্রতিনিধিরা।
জানা গেছে, সরকার এই জনগোষ্ঠীর জন্য শিক্ষা সহায়তার পাশাপাশি কর্মসংস্থান, প্রশিক্ষণ, ভাতা, আশ্রয়ণ প্রকল্পসহ নানা উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু আগামী এক দশকেও এসব উদ্যোগ পুরোপুরি বাস্তবায়ন হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় জানিয়েছেন তৃতীয় লিঙ্গের প্রতিনিধিরা।
যদিও জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে বৈষম্য দূরীকরণের উদ্যোগ নেওয়ায় তাদের ভাগ্য কিছুটা আলোর পথ দেখছে। তবে বিশ্লেষকদের মতে, এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে লিঙ্গ সমতা, দারিদ্র্য বিমোচন, বৈষম্য হ্রাস, মানসম্মত শিক্ষা, কর্মসংস্থান, অবকাঠামোসহ বেশ কয়েকটি বিষয়ের সুরাহা প্রয়োজন।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের প্রাথমিক জরিপ মতে, বাংলাদেশে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ রয়েছে প্রায় ১১ হাজার। যদিও তৃতীয় লিঙ্গের সংগঠনগুলো বলছে, তাদের সংখ্যা দুই লাখেরও বেশি। এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এ অনগ্রসর ও
অবহেলিত জনগোষ্ঠীকে মূলধারায় নিয়ে আসতে এক দশক ধরে নানা কর্মসূচি নিয়েছে সরকার। তাদের জীবনমান উন্নয়ন নীতিমালা-২০১৩ নেওয়ার পর বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু এসব উদ্যোগের অনেক কিছুই তৃতীয় লিঙ্গের নাগরিকদের কাছে যথাযথভাবে পৌঁছে না বলে অভিযোগ তাদের।
রাজধানীর বাড্ডা এলাকার বৃষ্টি নামের তৃতীয় লিঙ্গের একজন বলেন, ‘শুনেছি সরকার আমাদের জন্য অনেক কাজই করছে। কিন্তু আমরা এর কিছুই পাই না। এখনো মানুষের কাছে হাত পেতে টাকা তুলেই খেতে হয়।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রামপুরা এলাকার তৃতীয় লিঙ্গের আরেকজন বলেন, ‘মাঝে মধ্যে কিছু সংস্থা যেসব উদ্যোগ নেয় সেগুলো শো-অফ। কারোরই কর্মসংস্থান হয় না। দু-একজনের চাকরি হলেও কয়েকদিন পর বাদ দিয়ে দেয়।’
সমাজসেবা অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ২০১২-১৩ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো দেশের সাতটি জেলার তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে বাজেটে ৭২ লাখ ১৭ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। প্রায় এক দশক পর এ কর্মসূচি সম্প্রসারিত হয়ে ৬৪ জেলায় বাস্তবায়ন হচ্ছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তাদের জন্য সর্বোচ্চ বরাদ্দ গিয়ে দাঁড়ায় ১১ কোটি ৪০ লাখ টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটেও তাদের জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
সমাজসেবা অধিদপ্তর বলছে, পিছিয়েপড়া এই জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে তাদের দক্ষতা বাড়ানো ও কর্মক্ষমদের আয়বর্ধক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করে সমাজের মূলধারায় ফেরানোর কাজও চলছে। যারা যে ক্ষেত্রে আগ্রহী তাদের ৫০ দিন বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ প্রদান ও প্রশিক্ষণ শেষে প্রত্যেককে ১০ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। তবে এসব সুবিধা সহজে নিতে পারছেন না বলে অভিযোগ করেছেন অনেকে।
এ ব্যাপারে ‘সচেতন হিজড়া অধিকার সংঘে’র সভাপতি এস শ্রাবণী বলেন, ‘সরকার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে ঠিকই কিন্তু তা ফলপ্রসূ হচ্ছে না। কাজের বা কর্মসংস্থানের সুযোগ দিচ্ছে না।’
তিনি বলেন, ‘আমি কয়েকজনকে চাকরি করতে দিয়েছি। তারা কয়েক মাস পরই সেখানে আর চাকরি করতে পারেনি। অভিযোগ, তাদের সঙ্গে সাধারণ অন্য কর্মীরা কাজ করতে চান না। তাদের আচরণ নাকি ভালো না, মানুষ নাকি ভয় পায়। তাই প্রশিক্ষণ শুধু আমাদের নয়, সবারই দরকার। সবার সহযোগিতা প্রয়োজন।’
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, স্কুলগামী তৃতীয় লিঙ্গের শিক্ষার্থীদের শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে চার স্তরে মাসিক উপবৃত্তি দেওয়া হয়। প্রাথমিকে জনপ্রতি ৭০০ টাকা, মাধ্যমিকে ৮০০ টাকা, উচ্চ মাধ্যমিকে এক হাজার ও উচ্চশিক্ষায় এক হাজার ২০০ টাকা উপবৃত্তি দেওয়া হয়। শুরুতে ১৩৫ জনকে দেওয়া হলেও বর্তমানে তা বাড়িয়ে এক হাজার ৩৫০ জনকে উপবৃত্তি দিচ্ছে সরকার।
শুধু সরকারিভাবে নয়, ব্যক্তি উদ্যোগেও অনেকে তাদের জন্য কাজ করছে। রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরের লোহার ব্রিজ ঢাল এলাকায় মরহুম আহমেদ ফেরদৌস বারী চৌধুরী ফাউন্ডেশন কাজ করছে তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিদের উন্নয়নে। তারা যেন সমাজে সঠিকভাবে চলতে পারে সেই উদ্দেশ্য নিয়ে গত বছরের নভেম্বরে কামরাঙ্গীরচরের একটি ভাড়া বাসায় ফাউন্ডেশনটি শুরু করে দেশের প্রথম তৃতীয় লিঙ্গের মাদারাসা।
এ শিক্ষায় তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিদের আগ্রহ বাড়ায় মাত্র এক বছরেই ‘দাওয়াতুল কোরআন তৃতীয় লিঙ্গের মাদরাসা’ নামে প্রতিষ্ঠানটি ঢাকা শহরে খোলে ১২টি শাখা। বিভাগীয় শহরে হয়েছে আরো ১৪টি। প্রতিষ্ঠানটিতে পড়ালেখার জন্য তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিদের কোনো খরচ দিতে হয় না। ২০২০ সালে সরকার স্বীকৃত কওমি সিলেবাস অনুযায়ী মাদরাসাটি এখন পরিচালিত হচ্ছে। এর ফলে ওই সব এলাকার তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জীবনমানে কিছুটা হলেও পরিবর্তন এসেছে।