আহসান হাবীব সবুজ
ফায়ার সার্ভিস এ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের প্রশাসন অর্থবিভাগের পরিচালক জসীম উদ্দিনের দুর্নীতি যেন লাগামহীন ঘোড়া। যা থামানোর সাধ্য নেই কারও। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নীরবতাই তার প্রমাণ। অফিস সহায়ক নারীকে যৌন হয়রানি, চট্টগ্রাম বিভাগের অগ্নিকাণ্ডের তদন্ত প্রতিবেদনে ঘুষ দুর্নীতিসহ সীমাহীন দুর্নীতির অভিযোগ মাথায় নিয়েও বহাল তবিয়তে চেয়ার আকড়ে রেখেছেন তিনি। তাকে বাঁচাতে তৎপর ফায়ার সার্ভিস অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট।
তার সীমাহীন দুর্নীতি অনিয়ম ও নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগের বিষয়ে সম্প্রতি অসংখ্য দৈনিক ও অনলাইন পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পরেও টনক নড়ছে না কর্তৃপক্ষের। তার বিরুদ্ধে একাধিক সংবাদ প্রচার করা হলেও অদৃশ্য শক্তির বলে বহাল তবিয়তে রয়েছেন জসীম উদ্দিন। এসব অভিযোগ আমলে নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ তো দূরের কথা কার বিরুদ্ধে কোন তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়নি।
সূত্র জানায়, উপ-পরিচালক জসীম উদ্দিনের বিরুদ্ধে অধীনস্থ নারী কর্মচারীকে যৌন হয়রানি ও আত্মহত্যার প্ররোচণার অভিযোগের পাশাপাশি তার চাকরি জীবনে দুর্নীতি ও অনিয়মের অসংখ্য অভিযোগ নিয়ে একাধিক জাতীয় সংবাদমাধ্যমের সংবাদ প্রচার করা হয়েছে। এসব সংবাদে তার দুর্নীতি ও অনিয়মের ভয়ংকর চিত্র ফুটে উঠলেও ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থাই গ্রহণ করেনি বলে জানা গেছে। এমনকি সামান্য তদন্ত কমিটি গঠনের প্রয়োজনীয়তা মনে করেনি তারা।
ফায়ার সার্ভিসের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাদের হতাশা প্রকাশ করে সংবাদমাধ্যমকে জানান, জসীমের দুর্নীতি অনিয়ম ও নারী কেলেঙ্কারির এমন চিত্র প্রকাশ হওয়া ফায়ার সার্ভিসের মতো একটি গৌরবময় বাহিনী কলঙ্কিত হওয়ার শামিল। তার বিরুদ্ধে কোন প্রকার ব্যবস্থা না নেওয়ায় এসব কর্মকর্তারা তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ফায়ার সার্ভিসের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম বিভাগের সকল অগ্নিকাণ্ডের বিষয় তদন্ত প্রতিবেদনে জসিমের হস্তক্ষেপ রয়েছে এবং এসব প্রতিবেদনে ক্ষতিগ্রস্তদের নিকট থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ দাবি করা হয় এমন অসংখ্য তথ্য প্রমাণ উঠে এসেছে। ওই সব ক্ষতিগ্রস্তরা যদি দাবিকৃত ঘুষ প্রদানে ব্যর্থ হয় তবে প্রতিপক্ষের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে মনগড়া রিপোর্ট প্রদানের একাধিক অভিযোগ রয়েছে।
এছাড়াও জসীম উদ্দিন প্রশাসন ও অর্থ বিভাগের উপ-পরিচালক হওয়ার পর থেকে বেশ কয়েকজন কথিত রাজনীতিবিদ ও গোয়েন্দা বাহিনীর পরিচয়ধারী ব্যক্তির সখ্যতায় বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতি করে আসছেন। ওইসব ব্যক্তিরা জসিমের বিভিন্ন সুবিধার বিষয় দপ্তরের কর্তৃপক্ষকেও হুমকি ধামকি দেন বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে। দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়া উপ-পরিচালক জসিম উদ্দিন শ্বশুরবাড়ি এলাকায় সম্পদের পাহাড় করেছেন। এছাড়াও চট্টগ্রামে তার ছোট ভাইয়ের আমদানি ও রপ্তানির ব্যবসায় মোটা অঙ্কের মূলধন যোগান দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
অধীনস্থ ওই নারী কর্মচারীকে বছরের পর বছর যৌন হয়রানির অভিযোগের ঘটনায় সম্প্রতি জসিম ভুক্তভোগী নারী ও তার স্বামীকে বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ করে যাচ্ছেন বলে জানা গেছে। ওই নারীর স্বামী মাহবুবকে হেডকোয়ার্টারে তলব করে প্রশাসনের অর্থ বিভাগ, পরে তাকে বিভিন্ন রকম ভয়-ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে জসিম তার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সহায়তায় মুচলেকা দিতে বাধ্য করে। এই উপ-পরিচালকের নারী কেলেঙ্কারি ও দুর্নীতির বিষয় নিয়ে অধিদপ্তরের ভেতরে বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে তার পক্ষে কাজ করছে অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের একটি সিন্ডিকেট।
সূত্র আরও জানায়, ভুক্তভোগী ওই নারীর স্বামীকে কয়েকদিন আগে সদর দপ্তরে ডেকে পরিচালক ওয়াহিদুর ইসলামের মধ্যস্থতায় একটি মুচলেকা দিতে বাধ্য করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে ভুক্তভোগী নারীর স্বামী আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানা গেছে। রাখা মুচলেকার মাধ্যমে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন তিনি।
সূত্র আরও জানায়, জসীমের ভাই মেহেদি চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যের সাথে জড়িত। অবৈধ অর্থের বড় অংশ তার ভাইয়ের ব্যবসায় মূলধন খাটিয়েছেন তিনি। ওই ব্যবসার আড়ালে বিদেশে হুন্ডির মাধ্যমে অর্থপাচার করেন বলেও জানা যায়। যৌন হয়রানি, ঘুষ, দুর্নীতি ও আত্মহত্যায় প্ররোচণার মতো গুরুতর অভিযোগ উঠার পরেও কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কারণে জসিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে কোন প্রকার ব্যবস্থা না নেওয়ায় অধিদপ্তরের অনেকেই তাদের হতাশার কথা জানিয়েছেন।
উল্লেখ্য, যৌন হয়রানির অভিযোগ করা ওই নারীকে মানসিক অত্যাচারের মাধ্যমে আত্মহত্যায় প্ররোচণা করছেন জসীম উদ্দিন। ভুক্তভোগী নারী সুইটি বলেন, জসীম স্যারের অত্যাচার সইতে না পেরে আমি আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নেই এবং মহাপরিচালক স্যারের বরাবর জসিমের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ লিখে তৎকালীন মিরপুর ট্রেনিং সেন্টারের প্রিন্সিপাল সালেহ উদ্দিন স্যারের নিকট জমা দেই। কিন্তু আমার দেয়া ওই লিখিত অভিযোগটি প্রিন্সিপাল স্যার জসিমকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যে গায়েব করে ফেলেন, যা অধিদপ্তরে প্রেরণ করেন নাই।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ফায়ার সার্ভিসের একজন কর্মকর্তা জানায়, ডিডি জসীম উদ্দিন ফায়ার সার্ভিসের নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্যের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার আয়ের বহির্ভূত সম্পদ গড়েছেন। একজন নারী কর্মচারীকে যৌন হয়রানির মাধ্যমে ফায়ার সার্ভিসের মতো সেবা প্রদানকারী একটি সুশৃঙ্খল বাহিনীকে কলুষিত করেছেন তিনি। এমন ঘৃণিত অপরাধের বিষয় তদন্ত সাপেক্ষে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করা না হলে এই বাহিনীর শৃঙ্খলায় বিঘ্নিত হবে।
ডিডি জসীম উদ্দিনের বিরুদ্ধে এমন সব ঘৃণিত অপরাধ থাকার পরেও কেন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না এমন প্রশ্নের খোঁজখবর বেরিয়ে আসতে পারে আরও ভয়ঙ্কর অপরাধের চিত্র। বিষয়ে ডিরেক্টর এডমিন (প্রশাসন অর্থ) মোহাম্মদ ওয়াহিদুল ইসলামের বক্তব্য জানতে তার দুটি মোবাইল নাম্বারে ফোন করা হলে তিনি রিসিভ করেননি।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে ডিডি জসীম উদ্দিনের মোবাইলে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।