ঢাকা: প্রত্যেক প্রতিষ্ঠিত ধনী ব্যক্তিরই ধন্যাঢ্য হওয়ার পেছনে একটি গল্প রয়েছে। যার পরতে পরতে রয়েছে নানা চড়াই-উৎড়াই, শ্রম-ঘাম এবং কর্তব্যনিষ্ঠার কাহিনি। কিন্তু এর ব্যতিক্রমও আছে। রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলা বনে যান। অতঃপর শেষ ঠিকানা নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অনেক গড়েছেন অবৈধ সম্পদের পাহাড়।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে’র সূচকে সবার প্রথমে আসে বিভিন্ন আফ্রিকান দেশের নাগরিকদের নাম আসলেও এবারের চিত্রটা একটু ভিন্ন। এতদিন ধরে নানা ধরনের প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ডে শুধু নাইজেরিয়া, আ্যঙ্গোলিয়ান ও কম্বোডিয়ান নাগরিকদের নাম আসলেও এবার তাদের পেছনের মূলহোতা ধরা পড়েছে গোয়েন্দা পুলিশের হাতে। এরপর বেরিয়ে এসেছে এই প্রতারকের চাঞ্চল্যকরভাবে কুলি থেকে কোটিপতি বনে যাওয়ার ঘটনা।
নাম তার বিপ্লব লস্কর। ঢাকায় একাধিক ফ্ল্যাট ও প্লটের মালিক এই ব্যক্তি আপাদমস্তক একজন প্রতারক। অবৈধভাবে বাংলাদেশে থেকে যাওয়া আফ্রিকান নাগরিকদের মাধ্যমে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছ থেকে পার্সেলের নামে প্রতারণার মাধ্যমে সে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। আর এই প্রতারণার টাকায় কুলি বিপ্লব খুব অল্পদিনেই হয়ে উঠেন কোটিপতি। একশ’রও বেশি প্রতারণায় জড়িত বিপ্লব যেকোন মূহুর্তে গ্রেপ্তার হতে পারেন এটা জানতেন। তাই গাড়িতে ও তার সাথে সবসময় নেটওয়ার্ক জ্যামার থাকত। কিন্তু এত কিছুর পরও শেষ রক্ষা হলো না। ১০ জন সহযোগীসহ তাকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
গ্রেপ্তাকৃতরা হলেন- বিপ্লব লস্কর (৩৪), তার সহযোগী সুমন হোসেন ওরফে ইমরান (৩১), মোহসিন হোসেন ওরফে শাওন (৩০), ইমরান হাসান ওরফে ইকবাল (৩০), নাজমুল হক রনি (৩০), মোসা. নুসরাত জাহান (২৪)। এছাড়া নাইজেরিয়ান নাগরিক চিডি (৪০), ইমানুয়েল (২৬), জন (৩১), অ্যাঙ্গোলার নাগরিক উইলসন ডে কনসিকাউ (৩৫), ক্যামেরুনের নাগরিক গুলগ্নি পাপিনি (৩২)।
এসময় তাদের কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল, দুই রাউন্ড গুলি, একটি ম্যাগজিন, ২৮টি মোবাইল, একটি কম্পিউটার, ৪৯১টি এটিএম কার্ড, ২৬টি চেক বই, তিনটি ওয়ার্লেস পকেট রাউটার, একটি প্রাইভেটকার, সাড়ে ৩ লাখ জাল টাকা, নগদ ১১ লাখ ৩৫ হাজার টাকা ও ২৬৩টি সিম কার্ড জব্দ করা হয়।
সোমবার রাতে রাজধানীর মিরপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করে ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (উত্তর) বিভাগের ওয়েব বেজড ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিম।
মঙ্গলবার (৬ সেপ্টেম্বর) এ নিয়ে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরেন ডিবি প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ।
এ সময় তিনি বলেন, বিদেশিদের প্রতারণার শতাধিক ঘটনার সঙ্গে বিপ্লব লস্করের সম্পৃক্ততার সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে। তিনি গ্রেফতার এড়াতে গাড়িতে ও তার সঙ্গে সব সময় নেটওয়ার্ক জ্যামার ব্যবহার করতেন। এ কারণে দীর্ঘদিন ধরে তাকে গ্রেফতার করা যায়নি।
ডিবি প্রধান জানান, পার্সেল প্রতারক কখনো বাংলাদেশে বসে আবার কখনো দেশের বাইরে থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বন্ধুত্ব গড়ে পার্সেলে ডলার অথবা মূল্যবান উপহার পাঠানোর ফাঁদ পেতে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছিল। দেশি-বিদেশি প্রতারক সদস্যরা বিভিন্ন পন্থায় সাধারণ মানুষের ফেসবুক আইডি, হোয়াটসঅ্যাপ, ই-মেইল সংগ্রহ করে ইউএস আর্মি, ইউএস নেভিসহ বিভিন্ন পরিচয় ব্যবহার করে টার্গেটকৃত ব্যক্তিদের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তুলত। এক পর্যায়ে দামি উপহার স্বর্ণ, মূল্যবান পাথর, হিরা, বিশাল অংকের বৈদেশিক মুদ্রা (ডলার,ইউরো) পাঠানোর কথা বলে ফাঁদে ফেলত।
ব্যক্তির নাম-ঠিকানা উল্লেখ করে ভুয়া পার্সেলের ছবি পাঠাত প্রতারক চক্রটি। প্রতারিত ব্যক্তিরা সরল বিশ্বাসে পার্সেল গ্রহণের অপেক্ষায় থাকতেন। প্রতারক চক্রের কলিং বিভাগে কর্মরত বাংলাদেশি প্রতারকরা বিভিন্ন অপারেটরের নম্বর ব্যবহার করে নিজেকে কাস্টমস অফিসার পরিচয় দিয়ে পার্সেল এসেছে বলে জানাতেন। পার্সেলটি ছাড়াতে কাস্টমস হাউজ ফি বাবদ মোটা অংকের টাকা পরিশোধ করতে হবে বলে জানাতেন।
পার্সেল পাওয়ার আশায় ভুয়া কাস্টমস কর্মকর্তার দাবি করা টাকা পাঠিয়ে দিতেন ভুক্তভোগীরা। এরপর কাস্টমস কর্মকর্তা পরিচয়দানকারী ব্যক্তি আবারও ফোন করে জানাতেন, বিদেশি বন্ধুর পাঠানো পার্সেলে বিপুল পরিমাণ অবৈধ ডলার রয়েছে, যা ছাড়াতে আরও বেশি টাকা প্রয়োজন। এই টাকা দিতে ব্যর্থ হলে প্রতারিত ব্যক্তির নামে মানি লন্ডারিং আইনসহ অন্যান্য আইনে মামলা হবে বলে মিথ্যা ভয়ভীতি দেখাতেন।
প্রতারিত ব্যক্তিরা মামলার ভয়ে প্রতারকদের দেওয়া বিভিন্ন ব্যাংক আ্যকাউন্টে দাবিকৃত টাকা পাঠালে আবারও ফোন করে পুলিশ এবং সাংবাদিক জেনে যাওয়ায় তাদের ম্যানেজের কথা বলে আরও বড় অংকের টাকা দাবি করা হতো।
প্রতারকদের দাবি করা টাকা তাদের সরবরাহকৃত ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হওয়ার সাথে সাথে প্রতারণার শিকার হওয়া ব্যক্তিকে সকল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ যোগাযোগের সব মাধ্যমেই ব্লক করে দিত।
আর এই টাকা তোলা ও টাকা ভাগাভাগির কাজটি করতেন বিপ্লব লস্কর। তিনি বিদেশি নম্বর ব্যবহার করে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে সরাসরি তদারকি করতেন। লস্করের সহযোগী হিসেবে কাজ করতেন সুমন হোসেন ওরফে ইমরান, মোহসিন হোসেন ওরফে শাওন এবং ইমরান হাসান ইকবাল।
গ্রেপ্তার বিপ্লবের বিরুদ্ধে মোহাম্মদপুর, খিলক্ষেত ও কাফরুল থানায় মানি লন্ডারিংয়ের মামলা রয়েছে। এছাড়া তার বিরুদ্ধে বনানী থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলাসহ দেশের বিভিন্ন থানায় শতাধিক মামলা রয়েছে। এসব মামলায় তিনি একাধিকবার গ্রেপ্তার হয়েছেন বলেও জানান ডিবির এই কর্মকর্তা।